নবকুমার:
পাট জাত পন্য সারা বিশ্বে ছড়ি দিতে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাবলিক-প্রাইভেট প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এই শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বুধবার (৬ মার্চ) দুপুরে বঙ্গবন্ধু আর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ‘জাতীয় পাট দিবস-২০১৯’ উপলক্ষ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এরপর তিনি দুই দিনব্যাপী বহুমুখী পাটপণ্যের মেলা উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এছাড়াও ১৪টি ক্যাটাগরিতে ১৪ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পাট দিবসের পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, পাট থেকে সোনালি ব্যাগসহ অন্যান্য পণ্যকে আমাদের আরও ব্র্যান্ডিং করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। পাটের এসব পণ্য পরিবেশবান্ধব। তাই এগুলোর বড় বাজার রয়েছে। ঠিকভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পারলে বিশ্বব্যাপী বিরাট মার্কেট পাওযা যাবে এবং পাট থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। সোনালি ব্যাগের উৎপাদন আমাদের আরও বেশি এই সুযোগ তৈরি করে দেবে।
‘সোনালী আঁশের সোনার দেশ, জাতির পিতার বাংলাদেশ’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে তৃতীয়বারের মতো পাট দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে মন্ত্রণালয়। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো সাজানো হয়েছে পাট, পাটখড়ি, পাটপণ্য, রঙ-বেরঙের ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে। আর বিআইসিসিতে শুরু হলো দুই দিনের পাটপণ্যের মেলা, চলবে কাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত।
বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পাট আমাদের একটি কৃষিপণ্য। আমাদের শিল্পের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পাট রফতানিযোগ্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটি তৈরি হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগই আসত পাট থেকে। তবে বিশ্ব পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তি ও কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাবে একসময় পাটের চাহিদা সংকুচিত হয়ে পড়ে। তবে এখন আামাদের জন্য ভালো সম্ভাবনা এসেছে। মানুষ এখন পরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। আর পাট ও পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এসব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে। সে কারণেই পাট নিয়ে আমাদের সামনে সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই খাতের বিকাশের জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।
পাকিস্তান আমলেই পাটের ন্যায্য মূল্যের দাবির প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। এরপর থেকে এই পাটের ন্যায্য মূল্যের জন্যও কিন্তু বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করেছেন। ১৯৫২ সালে বন্দিখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি কনভেনশন করেছিলেন। ঢাকা বার কাউন্সিলের অ্যাসোসিয়েশনের হলে আয়োজিত সেই কনভেনশনে তার উত্থাপন করা দাবিগুলোর মধ্যে পাটের ন্যায্য মূল্যের দাবিও ছিল।
স্বাধীনতার উত্তরকালের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ পরবর্তী যেসব সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের ভেতরে পাটের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ছিল। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ছিল? আমি যেটা চিন্তা করি সেটা হলো— এরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল। তার অপরাধটা কী ছিল? তিনি দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন, এরপর বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আর তখনকার আমাদের রফতানি আয়ের অন্যতম কেন্দ্রে ছিল পাট। তাই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা যেন পাট শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন মেয়াদে পাট নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে পাটপণ্যের চাহিদা কতটুকু, তা খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন করতে হবে। এখন বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের বড় বাজার আছে। নতুন নতুন পণ্যের মাধ্যমে সেই বাজার ধরে পাটকে লাভজনক করতে পারব— এটা আমি বিশ্বাস করি। আমি হতাশ পার্টির সঙ্গে নেই, আমি সবসময় আশাবাদী।
শেখ হাসিনা বলেন, সোনালি ব্যাগের উৎপাদন আমাদের আরও বেশি সুযোগ তৈরি করে দেবে। আমাদের রফতানী নীতি ২০১৮ থেকে ২০২১ এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। পাটপণ্য আমরা যেন বেশি রফতানি করতে পারি, সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের এই সোনালি আঁশ পাট, যা থেকে সোনালি ব্যাগ থেকে শুরু করে অন্যান্য পণ্য হচ্ছে, এটাকে আমাদের আরও ব্র্যান্ডিং করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে পরিবেশবাবন্ধব পণ্য হিসেবে। তাহলেই বিরাট মার্কেট আমরা পেয়ে যাব এবং পাট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আরও ব্যাপকভাবে অর্জন করা যাবে।
পাট শিল্পে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে আরও সহযোগী খুঁজতে পারি। আমরা যদি তাদের সঙ্গে যৌথভাবে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো চালাই এবং সেখান থেকে বিশ্বের কোথায় কোন পাটপণ্য আমরা রফতানি করতে পারি, সেই বাজারও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। একসময় জুট ট্রেডিং করেপোরেশন, জুট মার্কেটিং করপোরেশন— এরকম বহু প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলো ‘৭৫-এর পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন সেগুলো চালু করার সুযোগ নেই। কিন্তু পাট নিয়ে গবেষণা ও নতুন পণ্য তৈরির পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজে বের করার সুযোগ রয়েছে।
সোনালি আঁশের সোনালি দিন আবার আমরা ফিরিয়ে আনার আশাবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি পাট শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের কৃষকদের ভাগ্য জড়িত, আমাদের মানুষের ভাগ্য জড়িত। তাছাড়াও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাট ও পাটপণ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজেই এই পাটের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি এবং দেশীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারি। সেইসঙ্গে পাটের বহুমুখী ব্যবহার আরও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করবার সুযোগ আমাদের রয়েছে।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ কিছু থাকবে, কিন্তু বেসরকারি খাতকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। তার জন্য আমরা অন্যান্য খাতে অনেক প্রণোদনা দিচ্ছি, এখানেও আমরা প্রণোদনা দেবো, যেন এই খাতের মধ্য দিয়ে তারাও ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমার দেশের পণ্যটাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে বিদেশে রফতানি করতে পারে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। বিশেষ অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মিজানুর রহমান।